শাশুড়ীর সঙ্গে একটা বেয়াদবি করার কারণে আমার প্রিয়তম স্বামী আমার গালে সজোরে থাপ্পড় মার'লেন।
বিয়ে হয়েছে প্রায় দশ বছর চলে, আমি এখন দুই বাচ্চার মা। স্বামী কখনো গায়ে হাত তুলেনি। অবশ্য গায়ে হাত তুলার মতো কোনো অন্যায় কখনো আমার দ্বারা হয়নি। অকারণে তো আর কোনো পুরুষ লোক নারীর গায়ে হাত তুলতে পারে না। যারা অকারণে নারীর গায়ে হাত তুলে তারা কাপুরুষের সমতুল্য।
ছোট মেয়েটা ভয় পেলো, দাদীর কাছে দৌড়ে গিয়ে বললো
" দাদু দেখে যা-ও না আব্বু মা'রছে আম্মুকে।
মেয়ে হাতে ধরে শাশুড়ীকে আমার রুমে নিয়ে আসলো। আমি রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখছি। হাসবেন্ড দুপুরের খাবার খেতে বাসায় এসেছিলেন। এখন চলে যাবে, খেতে আসলেও খায়নি অবশ্য।
" কি হয়েছে শিমু? রাফিন নাকি তোমাকে মেরেছে?
দুগাল হেঁসে বললাম " কিছু হয়নি তো মা! বসেন।
ততক্ষণে রাফিন বেরিয়ে পড়েছে।
কাপড়চোপড় গুছানো শেষে মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম ঘুম পাড়াবো বলে।
শাশুড়ী দুবার ডেকেছে খাইতে যাওয়ার জন্য। আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলেছি " খিদে নেই মা।
মেয়েটা ঘুমিয়ে গিয়েছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো একটা সময় আমিও কারো মেয়ে ছিলাম।
আজকে আমার আম্মা'কে ভীষণ মনে পড়ছে। আমি ছিলাম মায়ের অতি আদুরে সন্তান। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আম্মা আমাকে সবচেয়ে বেশি আহাল্দ করতো। পাড়াপ্রতিবেশি যখন কটাক্ষ করে বলতো "এতো আহাল্দি মেয়েকে শশুর বাড়িতে পাঠাবে কি ভাবে শাহেদা?
আম্মা তখন হেঁসে বলতেন " আমার মেয়ের সঙ্গে আমার দোয়া আছে। আমার মেয়ে পৃথিবীর সব জায়গায় আহাল্দি হয়েই বেঁচে থাকবে।
মায়েদের দোয়া মিথ্যা হয় না। আমার বিয়ের পর আম্মা আমার শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! আদরের মেয়ে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে।
আমার শাশুড়ী বড় ভালো মানুষ। তবে হ্যাঁ চলতে গেলে একটু আকটু খুটখাট হয়েই থাকে।
বিয়ের দুই বছর পর আমার ছেলেটার বয়স যখন নয় মাস বাইশ দিন। সেদিন কড়া রোদমাখা দুপুরে খবর এলো আম্মা আর দুনিয়ায় নেই। আমাদের ছেড়ে আমার আম্মা চিরদিনের জন্য বিদায় হয়েছেন।
কড়া রোদ, কিন্তু আমার হৃদয়ে উতালপাতাল ঝড় ওঠেছে।
আম্মার মুখখানা আর কখনো চোখের সামনে ভেসে উঠবে না ভাবতেই আমার কান্না আসলো।
আম্মা আর রাগ দেখাবে না, অভিমান করবে না। উপদেশ দিয়েও বলবে না যে "শিমু আমি সব সময় থাকবো না, শাশুড়ীই তোর মা। সে সব সময় তোর সাথে থাকবে তাই উনার সঙ্গে ভালো আচার-আচরণ করবি।
চারদিক যখন ফাঁকা, কোথাও আম্মা নেই ঠিক সে সময়ে আমার শাশুড়ী আমাকে যথেষ্ট সার্পোট দিয়েছেন। শাশুড়ী ভালো তো হাসবেন্ড ভালো। কারো সাথেই আমার সম্পর্ক খারাপ ছিল না। আম্মার কথা মতো আমি সর্বদা ভদ্র ভাবে চলাফেরা করতাম। কোনো ভুল না করারই চেষ্টা থাকতো। তাও যদি ভুল করে ফেলতাম শাশুড়ী অবশ্য ছেড়ে দিতো না। একটু আকটু কটুকথা আমি হজম করে নিতাম। সংসারে শান্তির দরকার আছে।
আজ শাশুড়ির সঙ্গে যে-ই বেয়াদবি টা করেছি সেটা হলো। কিছু দিন যাবৎ শরীরটা বড্ড খারাপ করছিলো। রাফিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেও সুযোগ করে উঠতে পারেনি।
সকাল প্রায় দশটা নাগাদ রাফিন বাজার থেকে ড্রাইভারকে দিয়ে অনেক বাজার-সদাই পাঠিয়েছে।
আমি তখন বিছানায় কাতরাচ্ছি। একটু আগেই সকালের নাস্তা ও কাজকর্ম শেষ করে,ছেলেটাকে টিফিন রেডি করে দিয়ে, বাপ ছেলেকে একসাথে বিদায় দিলাম।
ড্রাইভার ব্যাগপত্র শাশুড়ীর অব্দি পৌঁছে দিয়েছে।
প্রায় পনেরো বিশ মিনিট হয়ে গিয়েছে, আমি তখনও বিছানায়। শাশুড়ী এবার কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন "শিমু রাফিন বাজার পাঠিয়েছে এগুলো গুছিয়ে রাখবে কখন??
একে তো অসুস্থ শরীর তারউপর শাশুড়ীর চেঁচানো। আমার মেজাজ চটে গেলো। আমি বালিশে মুখ গুঁজে বললাম
" রেখে দেন না মা, আমি পরে করে নিবো।
এরপর রান্না ঘর থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ আসেনি।
আমি বারোটার দিকে শুয়া থেকে উঠে রান্না ঘরে গেলাম দুপুরের রান্না করবো। বুঝলাম শাশুড়ী সমস্ত কিছু গুছিয়ে ফেলছে। আমার শরীর তখনও খারাপ তাই শাশুড়ী কাজটা করে ফেলছে ভেবে আমার আনন্দই হলো। উনার প্রতি ভালো লাগাটাও বাড়লো। আমার আম্মা হলেও সেম এটাই করতো। কত শুয়ে-বসে কাটিয়েছি, আম্মার কোনো কাজে হাত দেইনি। তাও আমার মায়ের কোনো অভিযোগ ছিল না।
সমস্ত আনন্দ উবে গেলো যখন রাফিন বাসায় আসলো। রাফিন আমার সাথে বেশ চেঁচালো আমি কেনো বাজার-সদাই তার মা'কে দিয়ে গোছালাম। তার মা ডাকার পরেও আমি কেনো শুয়ে রইলাম, কেনো উঠে গেলাম না। এটাই আমার তার মায়ের সঙ্গে করা বেয়াদবি।
তখন খুব করে মনে হচ্ছিল শাশুড়ী আমার সাথে অনেক ভালো কিন্তু সে শাশুড়ীই, সে আমার মা নয়। আমার মা কখনো এটাকে বেয়াদবি হিসেবে নিতো না। আর না কারো কাছে নালিশ করতো।
যার যার মা তার কাছে শ্রেষ্ঠ। শাশুড়ীর সাথে আমার যতই ভালো সম্পর্ক থাকুক না কেনো আমি তার মেয়ে নই পুত্রবধূই, ঠিক তেমনি আমিও উনাকে যতই মায়ের মতো দেখিনা কেনো সে আমার মা নয় শাশুড়ীই।
অনুগল্প
মাকামে_মারিয়া।
0 Comments